বিদেশ ডেস্ক ::
উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তে মিয়ানমার সরকার গঠিত স্বাধীন কমিশনটি প্রথমবারের মতো ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। কমিশনের প্রধান ও ফিলিপাইনের সাবেক উপ-পররাষ্ট্র সচিব রোজারিও মানালোর নেতৃত্বাধীন একটি তদন্ত দল গত সপ্তাহে উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইনের মংডু শহর পরিদর্শন করে। ওই সময় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন তারা। মিয়ানমার টাইমসের এক প্রতিবেদন থেকে এসব কথা জানা গেছে।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দা ও সমালোচনার মুখে মিয়ানমার গত ৩০ জুলাই ইন্ডিপেনডেন্ট কমিশন অব ইনকোয়ারি গঠন করে। এতে মানালোর সঙ্গে আছেন জাতিসংঘে জাপানের স্থায়ী প্রতিনিধি কেনজো ওশিমা, মিয়ানমারের সাংবিধানিক ট্রাইব্যুনালের সাবেক সভাপতি উ মিয়া থেইন এবং ইউনিসেফের সাবেক কর্মকর্তা উ অং তুন থেট। তবে এই কমিশন আদতে সত্য উদঘাটন করতে পাবে কি না এ বিষয়ে এরইমধ্যে সন্দেহ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও কয়েকটি দেশ। মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর করা পূর্ববর্তী ‘তদন্ত’ থেকে এটি আদৌ আলাদা কিছু হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় জানিয়েছেন তারা। তবে এরইমধ্যে মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু করে দিয়েছে কমিশন।
কিছুদিন আগে জাতিসংঘ অভিযোগ করেছে, রাখাইনে সংকট শুরু হওয়ার এক বছর হয়ে গেলেও এখনও সেখানে কার্যকর প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। সংকট শুরুর পর থেকেই রাখাইনে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। যে কয়েকবার আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় এবং সীমিত পরিসরে। অভিযোগ ওঠেছে, সরকারিভাবে স্থানীয় শিখিয়ে-পড়িয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়েছে। এছাড়া এই কমিশনের রোহিঙ্গাদের কোনও প্রতিনিধি রাখা হয়নি।
মঙ্গলবার (৪ সেপ্টেম্বর) মিয়ানমার টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত সপ্তাহে কমিশনের সদস্যরা মংডুর বেশ কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শন করেছে এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে। এক বিবৃতিতে কমিশন একে ফলপ্রসূ বলে উল্লেখ করেছে। কমিশন বলছে মাঠ পর্যায়ের এ পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতিকে আরও ভালোভাবে বোঝার সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের বক্তব্য জানা গেছে।
মংডু জেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তা উ চিত মিয়ো ও বলেন, কমিশনের সদস্যরা নোগা খু ইয়া, শোয়ে জার এলাকা এবং মংডুর প্রশাসনিক কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। উ চিত মিয়ো ও আরও জানান, কমিশনাররা সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রাণে বেঁচে যাওয়া মুসলিম, হিন্দু ও রাখাইনদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
গ্রামবাসীদের সঙ্গে কমিশনের সদস্যদের আলাপকালে দোভাষী হিসেবে কাজ করেছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা উ মং হ্লা। তিনি বলেন, ‘তারা জানতে চেয়েছেন, এখানে থাকতে কোনও সমস্যা হয় কিনা? নিরাপত্তা বাহিনী আমাদের সঙ্গে সম্মানসূচক আচরণ করে কিনা?’ উ মং আরও বলেন, সন্ত্রাসীদের হাত থেকে হিন্দু সম্প্রদায়কে রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন কমিশন সদস্যরা। সন্ত্রাসীরা আবারও ফিরে আসতে পারে বলে এক হিন্দু নারীর পক্ষ থেকে আশঙ্কা প্রকাশের পর এ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
কমিশনের সদস্যরা মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি, ভাইস সিনিয়র জেনারেল সোয়ে উয়িন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল কিয়াও সোয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের আগস্টে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রাখাইনে পূর্ব পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ওই অভিযানে জাতিগত নিধনযজ্ঞের আলামত পেয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ মিয়ানমারের মানবাধিকার নিয়ে এক তদন্ত প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছে। মিয়ানমার সরকার বারবারই দাবি করে এসেছে যে, নিরাপত্তার স্বার্থে এই অভিযান চালিয়েছে সেনাবাহিনী। কোন নিধনযজ্ঞ চালানো হয়নি। তবে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রত্যাখ্যানের মাত্রায় তারা হতবাক। সামরিক অভিযানে কখনোই হত্যা, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, শিশু নিপীড়ন ও গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
পাঠকের মতামত